লিখেছেন: এবিএম কাইয়ুম রাজ
আমি কাইয়ুম রাজ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস, শীতের শুরু। ঠিক তখনই জীবনের এক স্মরণীয় সফরে বেরিয়ে পড়ি বান্দরবানের উদ্দেশ্যে—পাহাড়, মেঘ আর প্রকৃতির টানে।
আমাদের টিমে ছিল প্রিয় মানুষগুলো—ওসমান ভাইয়া, তাঁর স্ত্রী দিপা ভাবি, তাঁদের এক বছরের আদুরে মেয়ে রোজা মনি, রিপা আপু ও তাঁর ছেলে আজমাইন, আমার আন্টি, হাসান ভাইয়া আর আমি নিজে।
ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করি রাতের বাসে। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বান্দরবান শহরে পৌঁছাই সকালবেলায়। আমরা উঠেছিলাম “পালকি রেস্ট হাউস”, যা ছিল একেবারে পাহাড়ের ওপর—মেঘ ছুঁয়ে যাওয়ার মতো জায়গা। জানালা খুললেই দেখা যেত সবুজে ঘেরা পাহাড়, নিচে ঘুরপ্যাঁচানো রাস্তা আর দূরে মেঘের নরম চাদর।
প্রথম দিনেই আমরা ঘুরতে যাই নীলাচর। আমার ভাইয়া ইউনুস, যিনি বান্দরবানে চাকরি করেন, তাঁর সাথে দেখা হয়। সে আর তার বন্ধু হোসাইন আমাদের সঙ্গী হয় সেই দিনের ঘোরাঘুরিতে। নীলাচরের মাথায় দাঁড়িয়ে চারদিকের মেঘ, রোদ আর ঠান্ডা হাওয়া—সবকিছু একসাথে মিলে একটা স্বপ্নের মতো লাগছিল।
কিন্তু সবচেয়ে গভীরভাবে যে দিনটা আমার মনে গেঁথে গেছে, সেটা ছিল শুক্রবার, পরদিন।
সকালেই প্ল্যান করি নীলগিরি যাবো। তবে সমস্যা হয় গাড়ি নিয়ে। চাঁদের গাড়ি সময়মতো পাইনি, ফলে দুপুর ১২টার পর রওনা দিতে হয়। পাহাড়ি রাস্তায় চলার অভিজ্ঞতা আমার নতুন ছিল। আমি গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে দূরের দৃশ্য দেখতে থাকি—সবুজ পাহাড়, কুয়াশা, হঠাৎ হঠাৎ পাখির ঝাঁক, বুনো গন্ধ... মনে হচ্ছিল আমি সিনেমার ভিতরে ঢুকে পড়েছি।
নীলগিরি পৌঁছে খাওয়া-দাওয়া করি। গরম মোরগ পোলাও আর ঠান্ডা বাতাস—জীবনে প্রথমবার খাবারের সাথে প্রকৃতির এই কম্বিনেশন পেলাম। সবাই মিলে ছবি তুললাম, হাসাহাসি করলাম, ছোটরা দৌড়াদৌড়ি করল।
কিন্তু ফেরার সময় শুরু হয় এক ভয়ের সন্ধ্যা।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পাহাড়ি রাস্তায় আমরা নামতে শুরু করেছি। হঠাৎ দেখি গাড়ির হেডলাইট কাজ করছে না। আঁকাবাঁকা রাস্তা, অন্ধকারে একদম অদৃশ্য। ড্রাইভার মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চালাতে লাগল!
প্রথমে ভেবেছিলাম এটা মজা করছে কিনা, পরে বুঝলাম পরিস্থিতি সত্যিই ভয়াবহ। রোজা মনি হঠাৎ কেঁদে উঠল। আজমাইন মাকে শক্ত করে ধরে রাখল। চারপাশ নীরব, শুধু গাড়ির আওয়াজ। আমরা কেউ কথা বলছিলাম না, মুখ গম্ভীর, হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে।
মনেই হচ্ছিল, এই বুঝি শেষবার আলো দেখছি। আমরা ড্রাইভারকে প্রশ্ন করলাম, বকাবকি করলাম—ভয়ে, সন্দেহে, টেনশনে। কিন্তু তখন আমাদের কিছু করার ছিল না। শুধু দোয়া পড়ছিলাম, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছিলাম।
প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা আমরা পাহাড়ি রাস্তায় চললাম লাইট ছাড়া, মোবাইলের আলোয়। ঝাঁকুনি, ঢাল, বাঁক—সবকিছু যেন জীবন-মৃত্যুর খেলার মতো মনে হচ্ছিল। গাড়ির গতি মাঝে মাঝে বেড়ে যাচ্ছিল, ভয় আরও বাড়ছিল। আমি চুপচাপ বসে শুধু ভাবছিলাম—আল্লাহ, মা-বাবার মুখটা আর একবার দেখতে পারব তো?
এক সময় দূরে কিছু আলো দেখা গেল। দোকানপাট, মানুষের শব্দ, এক কাপ চায়ের গন্ধ যেন আমাদের আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনল। মনে হচ্ছিল—আমরা বেঁচে ফিরেছি।
এই সফর শুধু পাহাড় দেখার ছিল না, ছিল জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধির। আমি, কাইয়ুম রাজ, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বান্দরবান গিয়ে বুঝেছি—প্রকৃতি যেমন সৌন্দর্যের প্রতীক, তেমনি কখনো কখনো আমাদের ভয় পাওয়াতে পারে, শেখাতে পারে বিশ্বাস আর ধৈর্যের মূল্য।
এই আলোহীন সন্ধ্যা আমাকে শিখিয়েছে—জীবন সবসময় পরিকল্পনামাফিক চলে না, কিন্তু বিশ্বাস থাকলে আলোর দেখা একদিন ঠিকই পাওয়া যায়।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ আলহাজ্ব আবু কাওছার
মেইল: info@provatbarta24.com ভিজিট করুন: www.provatbarta24.com
@2025 provatbarta24.com All right reserved